‘প্রতিদিনের মতো সে-ই রাতেও আমরা দু'জন অশ্লীল চ্যাটে মগ্ন ছিলাম || দু‘আ কবুলের গল্প, পর্ব-০১ || Foyjul Bari Chowdhury

 



[১]


‘প্রতিদিনের মতো সে-ই রাতেও আমরা দু'জন  অশ্লীল চ্যাটে মগ্ন ছিলাম। তবে সে রাতের চ্যাট গুলো অশ্লীলতার গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল বহুদূর....


‘গল্প একদম শুরু থেকে বললে ভালো হবে। এক্ষেত্রে গল্পের প্লট সাজানোর ঝামেলা হতে রেহাই পাওয়া যাবে।’ ছেলেটিকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম।


আমার কথা শুনে ছেলেটি তার ব্যাগ হতে বোতল বের করে পানি পান করলো। অতঃপর মাথা নিচু করে গভীর ধ্যানে নিবিষ্ট হলো। বুঝতে পারলাম সে গল্পের শুরু খুঁজছে। আমাদের জীবনে এমন অসংখ্য গল্প আছে যেগুলো নিয়ে চিন্তা করতে নিজেদেরই দ্বিধা হয়। তবে ছেলেটির সাহসিকতা প্রশংসার দাবিদার। যখন জানতে পারল আমি লেখক অমনি তার জীবনের গল্প বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আর আমি যে মারাত্মক গল্প পোকা তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ছেলেটি গল্পের শুরু নিয়ে চিন্তায় ডুব দিল। আর আমি প্রকৃতি উপভোগের আশায় সিটের জানালা খুলতে দেখলাম, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশের গা তামাটে রঙ ধারণ করেছে। সবুজ-পাতায় মোড়ানো গাছগুলোর পাতার মাথা চুইয়ে মুক্তোর দানার মতো পানির ফোটা ঝরছে। ট্রেন ছুটে চলছে তার অবিরাম গতিতে। 


‘হুম মনে পড়েছে, দেড় বছর আগে তার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল।’


ছেলেটার কথা শুনে আবারও বাস্তব জগতে পদার্পণ করলাম। আমি ছেলেটার দিকে মনোযোগের দৃষ্টিতে তাকাতেই সে আবারও বলা শুরু করলো– ‘কোচিং-এর মাধ্যমে তার সাথে পরিচয়। ফেসবুকের কল্যাণে সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠলো। তো একদিন কোচিং-এ সবার সামনে হাঁটু গেড়ে তাকে প্রপোজ করলাম। তবে আমার গল্পটা কিন্তু বেশ ছোটো।’


গল্পের মাঝে অন্য কোন কথা বললে গল্পের মজা পানসে প্রকৃতির হয়ে যায়। আর এই জিনিসটা যথেষ্ট বিরক্তিকর!


‘সমস্যা নেই, তুমি কন্টিনিউ করো।’ শান্ত গলায় বললাম।


আমার পক্ষ হতে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে ছেলেটি বলতে শুরু করলো– ‘সেদিন সে আমার ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছিল। তখন মনে হয়েছিল আমি এই পৃথিবীর সকল সুখ হারিয়ে ফেলেছি। আবেগের বশে দেবদাস-এর মতো থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে সে সিদ্ধান্ত বেশিদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। উক্ত ঘটনার ২-৩ মাস পরে কোচিং-এর বিদায় অনুষ্ঠানের দিন মেয়েটা নিজেই আমাকে প্রপোজ করে। আমি আর এক মুহুর্ত ও দেরি না করে তার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে ফেলি। ওই সময় আমার ইসলাম নিয়ে জানাশোনা ছিল তবে সেটা নামমাত্র!  তবে এটুকু জানতাম যে বিয়ের আগে রিলেশন ইসলাম অনুমোদিত নয়। যা-ই হোক এগুলো কোন বিষয় না এটা চিন্তা করেই রিলেশন এগুতে লাগলাম। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই দু'জনেই বুঝতে পারলাম যে আমাদের সম্পর্কটা কেবলমাত্র শারীরিক আনন্দের জন্য। শুরু হলো অশ্লীল চ্যাটের আদানপ্রদান। শুরুতে সে উত্তর দিতে কিছুটা বিলম্ব করতো বা অনেকসময় প্রশ্ন এড়িয়ে যেত। তবে ধীরে ধীরে সে-ও আমার ম্যাসেজের সাড়া দেয়া শুরু করলো। এভাবেই কেটে গেল কিছু মাস। অবশেষে তাকে একটা কথা বলার জন্য মনস্থির করলাম। তবে কথাটা সে কিভাবে নিবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অবশেষে একরাশ আশা নিয়ে সে-ই রাতে তাকে জানালাম আমার মনের কথা।’


এটুকু বলতেই ছেলেটার দু’নয়ন অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়লো। লেখক হলেও আমি বেশ অধৈর্য একজন ব্যক্তি। গল্পের মধ্যে অল্প থেকে অল্প সাসপেন্স ও আমার জন্য বেশ বিরক্তির কারণ। আর ছেলেটির প্রতিটা কথা যে সাসপেন্সের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। ছেলেটি বললো– ‘সে-ই রাতে তাকে জানালাম যে আমি তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই। আর সে-ও সম্মতি জানালো। ঠিক করলাম আগামীকাল এক বন্ধুর বাসায় যাবো। বিশ্বাস করুন, সেদিন আমি অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম। পৃথিবীর সকল সুখ পাওয়ার জন্য আর একটি মাত্র দীর্ঘ রাত্রি অতিবাহন করতে হবে। কি করবো, কি করবো না সবকিছু ঠিক করে নিলাম। অত্যাধিক আনন্দের কারণে ঘুমোতে কষ্ট হচ্ছিল। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর ঘুমোতে সক্ষম হলাম। ঘুম থেকে উঠে সর্বপ্রথম তাকে কল দিলাম কিন্তু সে কল ধরেনি।  পরপর ৬ বার কল দেওয়ার পরও যখন সে কল ধরলো না তখন মনে করেছিলাম সে হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তার সাথে অনেকভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ধৈর্যের সীমা ভেঙ্গে যাওয়ার পর তার বাসার উদ্দেশ্য পথ চলা শুরু করলাম। তার বাসার কাছাকাছি পৌঁছুতে লক্ষ্য করলাম সেখানে অসংখ্য মানুষের ভিড়! ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখলাম একটি খাটের উপরে সাদা কাপড় মুড়িয়ে কাউকে শায়িত করে রাখা হয়েছে।’


ছেলেটি আবারও থেমে গেল। অতঃপর অল্প পানি পান করে আবারও বলতে শুরু করলো– ‘প্রথমে বুঝতে পারিনি যে লাশটি কার। পরবর্তীতে সবার কথোপকথনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলাম যে লাশটি সে-ই মেয়েটির যার সাথে আমার ও-ই দিন এক বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল।’


আমার জানা নেই এই মুহূর্তে কি বলতে হবে। আমি শব্দহীন হয়ে পড়েছি। সহসা ঘটনা এমন মোড় নিবে তা কল্পনাও করিনি।


‘আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারলাম না। কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ছে না সেদিনের মতো আমি আমার জীবনে আর কখনও কেঁদে ছিলাম কি-না? আমি মনে করেছিলাম সে-ই দিন আমি পৃথিবীর সকল সুখ পেতে যাচ্ছি। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই আমি ভুল! তবে এখন উপলব্ধি করতে পারছি যে সেই দিনটি আমার জন্য খারাপ হলেও রাত্রিটা ভিন্ন ছিল। সে-ই রাত্রে আমি মহান আল্লাহ কে চিনেছিলাম। আমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে তা উপলব্ধি করেছিলাম। সে-ই রাতে রবের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিলাম।’


‘এখন কি আর তার কথা মনে পড়ে না?’ ছেলেটিকে কথার মাঝে থামিয়ে জানতে চাইলাম।  


‘পড়ে না বললে মিথ্যা হবে। মাঝে মাঝে ঠিকই মনে পড়ে। আর তখন মহান আল্লাহ কে বলি তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। এটুকুই আমার গল্প। আর হ্যাঁ পুরো গল্প জুড়ে কেন কোন চরিত্রের নাম বলিনি বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়?’


‘হুম বুঝতে পেরেছি। ওয়ান লাস্ট কোয়েশ্চন। এখন জীবন কেমন বা জীবন হতে চাওয়া পাওয়া কি?’


‘এইতো প্রায় ছ'মাস হতে চললো প্রত্যাবর্তন করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ভালোই রেখেছেন। জীবনে আগের মতো দুঃখ, হতাশা ইত্যাদি নেই। আর যদি কখনও কষ্টে পেয়ে থাকি  তখন তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আমার সকল কষ্ট মহান আল্লাহ কে জানিয়ে দেই। আর চাওয়া-পাওয়া বলতে শুধু একটাই, মৃত্যু যেন সিজদাহ্ রত অবস্থায় হোক। আশাকরি আপনি সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। আচ্ছা গল্পের নাম কি দিবেন?’


‘সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে।’ 


’আচ্ছা। তবে আশাকরি ভালো নাম-ই দিবেন। অনেক রাত হয়েছে আমাদের শুয়ে পড়া উচিত হবে।’


‘অবশ্যই’


    [২]


পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আমার নেই বললেই চলে। তবুও মাঝে মাঝে পড়ার চেষ্টা করি। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎ একটি শিরোনামের উপর চোখ আটকে গেল। শিরোনামটি এমন, “মসজিদে সিজদাহ্ রত অবস্থায় এক যুবকের মৃত্যু” শিরোনামের ঠিক নিচেই একটি ছবি সংযুক্ত করা। ছবিতে একজন যুবককে সিজদাহ্ রত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। আর পাশেই ও-ই যুবকের একটি ছোট্ট ছবি লাগানো। আমার আর চিনতে অসুবিধা হলো না। এটা সে-ই ছেলে যার সাথে আমার ট্রেনে সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন ঘুম থেকে উঠে ছেলেটিকে আর পাশে পেলাম না। প্রায় একমাস হতে চললো ছেলেটির বলা গল্পের জন্য নাম খুঁজছি কিন্তু কিছুতেই মনমতো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ছেলেটির বলা গল্পটি আমার প্রকাশিতব্য বইয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আছে কিন্তু সুন্দর একটি নামের অভাবে তা এখনও যোগ করা হয়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে তার গল্পের জন্য কাঙ্ক্ষিত নাম পেয়েছি। “দু‘আ কবুলের গল্প” অস্ফুট স্বরে বললাম। 


হঠাৎ ভাবনার মাঝে ছেদ পড়লো। অর্ধাঙ্গিনী কোরআন তিলাওয়াত করছে। কোরআনের চমৎকার এক আয়াত তিলাওয়াত করছে যা বর্তমান মুহুর্তের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর তা হলো, সূরা যুমারের ৫৩ নাম্বার আয়াত- 

“বলুন, 'হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”


     || দু‘আ কবুলের গল্প ||

~ Foyjul Bari Chowdhury

No comments

Theme images by Storman. Powered by Blogger.